কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ওয়েলেসলি স্ট্রিট আর পিটার্স লেন—এই দু'পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা মডার্ন ইন্সটিটিউশন যেন এক ধ্রুপদী শিক্ষাগৃহের প্রতীক। সাদা দালানের শুদ্ধ-সুশৃঙ্খল উঠোন পেরিয়ে, কাঠের পুরনো বেঞ্চ আর ব্ল্যাকবোর্ডের আঁচড়ঘেরা ক্লাসরুমে গড়ে উঠেছে শত শত মেধার বীজতলা। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্লার্কওয়েল সাহেব, যিনি স্বদেশী না হয়েও শিক্ষার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠায় নিজেকে করে তুলেছেন অনন্য। শহরের মানুষের কাছে তাই স্কুলটা পরিচিত হয়ে উঠেছে “ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল” নামেই।
এই স্কুলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে একগুচ্ছ মানুষের জীবন। যদুবাবু, ক্ষেত্রবাবু, নারায়ণবাবু, মি: আলম, জ্যোতির্বিনোদ, রামেন্দুবাবু, এমনকি তরুণী ইংরেজি শিক্ষিকা মিস সিবসন—সবার অস্তিত্ব যেন গাঁথা এই ইট-কাঠ-খড়ের মাঝে। কিন্তু সময় বদলায়, বদলায় সম্পর্ক, দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্বাস।
একসময় এই আস্থা ও জ্ঞানের নিভৃত আশ্রমেই জন্ম নিতে থাকে ভ্রান্তি, শঙ্কা আর অবিশ্বাস। এদিকে পৃথিবীজুড়ে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর উত্তেজনার মাঝেও এই স্কুলের চার দেয়াল হয়ে ওঠে শিক্ষকদের কাছে এক আশ্রয়, এক নীরব প্রতিরোধ—যেখানে জীবনের গভীরতা বোঝা যায়, আবার যেখানে মানসিক কারাবন্দিত্বও ক্রমে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
তবু, শত বছর পরেও এই স্কুলে কান পাতলে শোনা যায় ক্লার্কওয়েল সাহেবের সেই অনমনীয় বাক্য—
“যদি না পোষায়, মাই ডোর ইজ ওপন…”
—যা শুধুমাত্র একটি দরজা নয়, বরং একটি চিন্তাভাবনার, একটি জীবনের, একটি মর্যাদার পথনির্দেশ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল” যেন এক গৌরবময় বিদ্যাপীঠের গোপন ইতিহাস—মানবিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাক আর আত্মপরিচয়ের সন্ধানের এক নীরব উপাখ্যান।
0 Review(s) for অনুবর্তন (হার্ডকভার)